”ব্যাক স্টেজ ”
-পূজা মৈত্র
অভিমন্যু সাহস করে ফোনটা করেই ফেললো। টিউশন শেষ। বিকাল পাঁচটার পরের টিউশনটায় যাবে না। অনুস্মিতা ম্যামের বাড়ি যাবে। অনুস্মিতা ম্যাম নামী ফটোগ্রাফার। ওদের স্কুলের অ্যালুমনি। দিন সাতেক আগে স্কুলের আমন্ত্রণেই ওদের একটা ওয়ার্কশপ করাতে এসেছিলেন। দিন তিনেকের। ইন্ট্যারেস্টেড গোটা পঞ্চাশেক স্টুডেন্টের মধ্যে অভিমন্যুও ছিলো। ফটোগ্রাফি শেখার ইচ্ছা ওর বহুদিনের। বাড়িতে বলার সাহস নেই। মা দামী মোবাইলই দেয়নি তো ডিএসএলআর।
তাই রিশিনের ক্যামেরার ভরসাতেই নাম দিয়ে ফেলেছিলো ওয়ার্কশপে। ভাগ্যিস দিয়েছিলো! নাহলে অনুস্মিতা ম্যামের সাথে দেখাই হতো না। আর দেখা না হলে অভিমন্যু বুকের বাঁদিকে আজ যে জিনিসটা অনুভব করছে সেটা কখনোই বুঝতে পারতো না।
অনুস্মিতা ম্যামের বয়স কতো হবে? দেখে তো মনে হয় বাইশ-তেইশ। রিশিন বলেছিলো বেশিই হবে। বছর সাতাশ নাকি। ও ম্যামের ফেসবুক প্রোফাইল দেখে বুঝেছে। ওয়ার্কশপে অভিমন্যুর মতো বেশিরভাগ ছেলেই ক্রাশ খেয়েছিলো ওনার উপর – কিন্তু অভিমন্যুর মতো ম্যামকে ইম্প্রেস করতে কেউ পারেনি। পারবেই বা কি করে অভিমন্যু জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিলো ওয়ার্কশপে। ম্যাম যেমনটা বলেছে তেমনটাই করতে পেরেছে তাই। ম্যাম খুশি হয়েছিলো, ফোন নাম্বার দিয়েছে।
অভিমন্যু হোয়াটস্যাপে পিং করলেও উত্তর দিয়েছে। ফটোগ্রাফি নিয়ে রাজ্যের প্রশ্ন করলেও বিরক্ত না হয়ে জবাব দিয়েছে। অভিমন্যুর ফটোগ্রাফিটা হবে, ওর হাত আছে ম্যাম বলেছেন বারবার। কোথাও ভর্তি হতে বলেছেন। সামনে এইচ এস শুনে বলেছেন – তাহলে কলেজে উঠে। অভিমন্যু জানে সেসবের কিছুই হবে না। ওর মা চায় ও ডাক্তারি পড়ুক। এইচ এসের পরে ওকে নিটের জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে। ওর ইচ্ছা মতো কিছু হবে না। কেমিস্ট্রি অনার্সটাও না। ফটোগ্রাফি তো বহুদূরের কথা। সেসব ও ম্যামকে বলেনি। ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়বেই বলেছে। না বললে ম্যাম ওর সাথে কেনই বা কন্ট্যাক্ট রাখবে? কেনই বা ওকে শেখাতে চাইবে?
“চললি কোথায়?” নীলেশের কথায় তাকালো অভিমন্যু, “ঐ একটু-” “ডেটিং?” সত্যিটা বলা যাবে না। “শর্ট অফ” “জিও পাগলা, কোথায় – লেকে? নাকি ওয়োরুম?” অভিমন্যুর কান লাল হয়ে যাচ্ছিলো। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো ওর। “ঐ আর কি।” নীলেশ অভিমন্যুর পিঠে চাপড় মারলো। “করেছো কি! আন্টি জানে?” অভিমন্যু মাথা নাড়লো, “না না। নীলেশ খবরদার বলবি না কিন্তু মা কে।” নীলেশের বাড়ি ওদের পাড়াতেই। সব টিউশনই প্রায় ওর সাথে ট্যাগড। সাবজেক্ট কম্বিনেশনও এক। “আমি তো বলবো না ভাই – কিন্তু আন্টি কে তো চিনিস। তোর লেট হলে আমার মা’কে কল করবে – আর আমি চলে এসেছি জানলে তোর কপালে শনি নাচবে। তাই ভাই – যা করার জলদি করে ফিরে এসো।” অভিমন্যু চুপ করে থাকলো।
নীলেশ ভালো করেই জানে অভিমন্যুর বাড়িতে কেমন শাসন। “শোন না ভাই – বায়ো টিউশন শেষ হলে একটা কল করিস আমায়, কেমন?” “কল? আর ইউ শিওর? কল ধরার মতো অবস্থায় থাকবি তো?” নীলেশ হাসলো। “নাকি অন্য বায়োলজিকে ডুবে থাকবি। প্রোটেকশন নিয়েছিস তো?” “প্রোটেকশন?” “হেলমেট না পরেই পিচে ব্যাট করতে নেমে যাবি?” “হেলমেট?” “চার অক্ষরের বোকা তুই, কন্ডোম রে।” “ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ – আছে।” “ঠিক আছে তাহলে। কে রে মেয়েটা? হৃষা? কেমিস্ট্রি টিউশনের?” “পরে বলবো সেটিং হোক। নীলেশ, ফোন করিস ভাই।” “করবো। তুই বইয়ের বায়োলজি না বুঝতে গিয়ে – প্র্যাক্টিক্যাল বায়োলজি করতে গেছিস জানলে অ্যান্টি কী করবে জানি আমি। বেস্ট অফ লাক, জলদি কাজ মিটিয়ে আয়।” নীলেশ চোখ মারলো।
নীলেশকে কোনরকমে কাটিয়ে উবেরে চড়লো অভিমন্যু। চারটে পঞ্চাশ বাজে। লেট হয়ে গেছে। দশমিনিটে পৌঁছতে হবে। তাই উবের করলো। ও পড়তে এসেছিলো হাজরা। ম্যামের ফ্লাট লেক গার্ডেন্সে। তবুও চান্স নেবে না অভিমন্যু। যদি দেরি করেছে বলে ম্যাম রেগে যায়? যদি বলে বেরিয়ে যাবে অন্য কাজে? না না সেই চান্স নেওয়ায় যাবে না। অনেক কষ্ট করে অনেক বলে কয়ে আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা পেয়েছে অভিমন্যু। কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না এটা। ম্যামের জন্য একটা চকোলেট কিনেছে অভিমন্যু। খাবে কী? না জেনেও কিনেছে। ফার্স্ট ডেট বলে কথা। ভেবেই মনে মনে হাসলো অভিমন্যু। ম্যাম জানে ফার্স্ট ওয়ান টু ওয়ান ক্লাস। অভিমন্যুর কাছে সেটাই ডেট। ম্যামকে সামনাসামনি দেখতে পারবে, ঘন্টা খানেক। দুচোখ ভরে দেখবে অভিমন্যু। যেমন স্বপ্নে দেখে আজকাল, রোজ, ম্যামকে। খুব কাছ থেকে দেখে, দেখতে চায়। কাছে যেতে চায় ম্যামের, হাত দুটো ধরতে চায়, ম্যামকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এতো কিছু দেখার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। উঠেই ওয়াশরুমে যেতে হয় অভিমন্যুকে। নাহলে শান্তি পায় না। তাছাড়া ইনার ওয়ারে কোন ডিসচার্জ যাতে না লাগে সতর্ক থাকতে হয় অভিমন্যুকে। মায়ের চোখে পড়লে বিপদ।
নীলেশ সন্দেহটা হৃষাকে নিয়ে করেছে। এটা ভেবে মনে মনে একটু হাসলো অভিমন্যু। হৃষা ওর ক্লোজ ফেন্ড। অভিমন্যুকে প্রপোজও করেছিলো মাসতিনেক আগে। অভিমন্যু না করে দিলে পরে সব সহজ করে নিয়ে ফ্রেন্ডেস্ উইথ বেনিফিটস্ হতে বলেছিলো। অভিমন্যুর সেই সাহস হয়নি। হৃষাকে এড়িয়েই যায় অভিমন্যু। সেই থেকেই। নীলেশ, রিশিনদের মতো সাহস নেই ওর। আন্ডার এজ হয়েও দিব্যি ওয়োরুমে চলে যায় ওরা। টিউশনেরই কোন মেয়েকে নিয়ে। ফ্রেন্ডস্ উইথ বেনিফিটস্। এমন অনেকেই আছে ওদের। নীলেশের তো ব্রেক আপ হয়েছে সদ্য। তারপর থেকেই যেন আরও ফাক বয় হয়ে গেছে। অভিমন্যু টিউশন ড্রপ করবে শুনে তাই ওয়োরুম আর হৃষার বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি নীলেশ। ভাবুক। ঠিকটা ওকে জানতে দেওয়া যাবে না। ভুলটাই জানুক। আর জানলে অভিমন্যুরই লাভ।
ওরা ওকে অন্তত আনাড়ি ভাববে না। ন্যুব ভাববে না। তবে যদি স্বপ্নের মতো সত্যিই ম্যাম অভিমন্যুকে হ্যাঁ করে দেয়। যদি অভিমন্যু ম্যামের বয়ফ্রেন্ড হয়ে যায় – পরশু দিনের স্বপ্নের মতো? হাত ধরাধরি করে পার্কে ঘুরছিলো দুজনে। ম্যাম আর অভিমন্যু, ধুস্! তা হয় নাকি! অভিমন্যু হয়তো দশ এগারো বছরের ছোট ম্যামের থেকে। কিন্তু তাতে কি? সাইফও তো অমৃতার থেকে তেরো বছরের ছোট ছিলো। ফেসবুকে পড়ছিলো অভিমন্যু সেদিন। আর অভিমন্যুই বা কম কিসে? প্রায় ছয় ফুট লম্বা ও, দোহারা চেহারা। রোগা না ওর বয়সের আর ছেলেদের মতো। দেখতেও বেশ ভালো। অন্তত মেয়েরা আর আয়না তাই বলে। গায়ের রঙও ফর্সা বেশ। এককথায় হ্যান্ডসাম অভিমন্যু। অনেকটা মায়ের মতো দেখতে ওকে। বেশ বোঝে ও। মা এখনো খুব সুন্দরী। ক্লাসি, এলিগ্যান্ট। মায়ের কলেজের সব স্টুডেন্টরাই সুদর্শনা ম্যাম বলতে অজ্ঞান। নামী কলেজর প্রফেসর মা, জুলজির। ডাক্তার হতে চেয়েছিলো – এখন চায় অভিমন্যু ডাক্তার হোক। মা নিজের সব স্টুডেন্টদের আইডল বলা যায়। সবার সাথেই খুব ফ্র্যাঙ্ক। কেবল অভিমন্যুর সাথে না। অভিমন্যু আর মায়ের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব। কর্ত্রী ও আজ্ঞাবাহকের মতো সম্পর্ক ওদের।
দিনের প্রতিটা মুহুর্ত ওকে মা ঘড়ি ঘন্টা মেপে চালায়। তাই হৃষা বা অন্যমেয়েরা চাইলেও অভিমন্যু সাড়া দিতে পারেনি। আজই প্রথম কোথাও যাচ্ছে মা’কে লুকিয়ে। ধরা পড়লে অভিমন্যু জানে ওর কি হবে। অথচ ওর আজ নিজেকে আটকাবার উপায় নেই। ম্যাম যখন নিজে থেকেই বলছে সব ডাউটগুলো বুঝিয়ে দেবে বাড়ি এলে অভিমন্যু নিজেকে থামাবে কি করে?
অনুস্মিতা ম্যামের লেকগার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে এসে অবাক হলো অভিমন্যু। এতো বড় ফ্ল্যাট। একাই থেকে? মাসি আছে একজন। একটা মিষ্টি গোল্ডেন রিট্রিভারও। কিন্তু মানুষ? ম্যাম আনম্যারেড জানে অভিমন্যু। কিন্তু ম্যামের মা বাবা কোথায়। ম্যাম বাড়িতে ক্যাজুয়াল আউটফিটেই রয়েছে। একটা গোল গলা টি-শার্ট আর একটা পাজামা টাইপ প্যান্ট। চুল উঁচু করে বাঁধা। অভিমন্যুর পাশেই বসেছে এখন। সোফায়। এতোক্ষণ ওরা ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের ছাদে গিয়েছিলো। ম্যাম যেভাবে যে যে অবজেক্টকে শ্যুট করতে বলেছে, করেছে অভিমন্যু। ম্যাম এবার ল্যাপটপে সেগুলো নিয়ে দেখছে। টানা একঘন্টা ছাদে ম্যানুয়াল মোডে শ্যুট করেছে ওরা। উইথাউট ব্রেক। ম্যাম খুব সিরিয়াস কাজ করার সময়। একটুও মজা করে না। ঘড়ি দেখছিলো অভিমন্যু। ছটা দশ। সাড়ে ছটার মধ্যে বেড়তে হবে এখান থেকে। নাহলে বিপদ। এদিকে কথাই তো হলো না সেইভাবে। “ম্যাম-” সাহস করে বললো অভিমন্যু। “বলো। খিদে পেয়েছে? কিছু খাবে? মুখটা শুকনো লাগছে তো।” অভিমন্যু চুপ করে থাকলো। “ঠিক ধরেছি। স্কুল থেকে সোজা টিউশন গেছো – সেখান থেকে এখানে।
মাসি – মাসি টিফিন করে দাও বাবুকে। কী খাবে দেখো।” বাবু! ম্যাম ওকে বাচ্চা ভেবে ডাকলো না আদর করে, “ না, না। ঠিক আছে। বাড়ি যাবো তো একটু পরেই।” ম্যাম ওর পিঠে হাত রাখলো। “এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। খিদে পেয়েছে লুকোতে হবে না।” অভিমন্যুর সারা শরীরে অদ্ভুত একটা স্পার্ক খেলে গেলো যেন। কোন মেয়ের কাছে এলে এভাবে ফিল করেনি কখনো। হৃষাও কাছে এসেছিলো একবার। কেমিস্ট্রি টিউশন ব্যাচের পর, স্যারের বাড়ির পাশের গলিতে। কিসও করেছিলো ওরা, অন্ধকারে। তবুও এই স্পার্কটা সারা শরীরে অনুভব করেনি অভিমন্যু তখন। ম্যাম বুঝলো ও অন্যমনস্ক। “ছবিগুলো বেশ ভালো তুলেছিস। কিন্তু প্র্যাকটিস লাগবে আরো।” ম্যাম বললো। তুই! ম্যাম ওকে বাচ্চাই ভাবছে তাহলে। অভিমান হলো অভিমন্যুর। কিন্তু কিছু করার নেই। একদিনেই সবটা বোঝানো যায় না তো। “নে খেয়ে নে। বাড়িতে ডি এস এল আর আছে?” অভিমন্যু মাথা নাড়লো, নেই। মাসির করা চাউমিনের প্লেটটা হাতে নিলো ও।
“তুমি খাবে না?” ম্যাম কে ইচ্ছা করেই তুমি বললো অভিমন্যু। এমন কিছু বড় না, দশ বারো বছরের বড়। তুমি বলাই যায়। “আমি এই একটু আগে লাঞ্চ করেছি।” “এতো বিকালে, লাঞ্চ!” “কাজ ছিলো যে!” “তোমায় কেউ বকে না – এতো অডটাইমে লাঞ্চ করার জন্য।” অনুস্মিতা হেসে ফেললো, “নাহ্, কে বকবে? বড় হয়ে গেছি তো?” “কেন তোমার মা-বাবা? এতো লেটে লাঞ্চ করলে তো শরীর খারাপ হবে।” “মা-বাবা অনেক দূরে থাকে রে। শিলিগুড়ি। এখানে আমি একাই থাকি। আসলে কাজ করতে বসলে কিছু মনে থাকে না। দেরি হয়ে যায়।” “আমি মনে করিয়ে দেবো তোমায় – হবে?” অনুস্মিতা তাকালো অভিমন্যুর দিকে। বেশ মিষ্টি দেখতে ছেলেটাকে। ওদের বয়সের আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের তুলনায় অনেক সরল, অনেক পিওর। ফটোগ্রাফি শেখার ইচ্ছাটাও ষোল আনা। ওকে না করতে পারে না অনুস্মিতা। মায়া করে। “তাহলে তো ভালোই হলো। বাবু আমায় মনে করিয়ে দেবে এবার থেকে।” “ইস্! বাবু না!” “কেন?” “আমি বাচ্চা নাকি?” অনুস্মিতা হেসে ফেললো। অভিমন্যুর মাথার চুল উল্টে পাল্টে দিলো, “বাচ্চাই তো!” “না।” “রাগ হলো?” “আগে বলো বাচ্চা না। মা-ও সারাদিন বাচ্চার মতো ট্রিট করে এখনো। এটা করা যাবে না – ওটা করা যাবে না। তুমিও বলছো।” অনুস্মিতা আলতো করে গাল টিপে দিলো অভিমন্যুর, “বাবু তো আদর করেও ডাকা যেতে পারে। বাচ্চা না ভেবেও।” অভিমন্যুর মনে ধরলো কথাটা।
“তাহলে ঠিক আছে। এই যা!” “কী হলো রে?” “তোমার জন্য চকোলেট এনেছিলাম। ভুলেই গেছি দিতে।” তড়িঘড়ি চকোলেট বার করলো অভিমন্যু। অনুস্মিতা চকোলেট খায় না তেমন, তাও হাসি মুখে নিলো।, “থ্যাংক ইউ। কাজের কথা শোন এবার, বাড়িতে ডি এস এল আর নেই, প্র্যাক্টিস করবি কি করে? বাবাকে বললে কিনে দেবে?” অভিমন্যু মাথা নাড়লো। মা-কে না বললে ওদের বাড়িতে কিছু হয় না। বাবা বড্ড চুপচাপ। বাবাও প্রফেসর, ইংরেজির। নিজে লেখালিখিও করেন। নিজের জগতেই থাকেন বেশীরভাগ। “নাহ। মা’কে বলতে হয় সব। বাট মা দেবে না। মা চায় আমি ডাক্তারি পড়ি। এই দেখো না – জাস্ট ইলেভেনের মাঝখান এখন। এখন থেকেই বলবে সামনে এইচ এস আর তারপর নিট এন্ট্রান্স। নিটের কোচিং বলছি এখন না এইচ এসের পর, তাও বলছে পরের মাসে ভর্তি করিয়ে দেবে।” অনুস্মিতা অভিমন্যুর ডাক্তারি এন্ট্রান্স দিতে আপত্তিটা বুঝলো, “মা’কে বলিসনি যে পছন্দ না ডাক্তারি?” “মা’কে? খেপেছো? বললে আমি শেষ। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে যাবে।” অনুস্মিতার খারাপ লাগলো। এই দেশে এখনও কেরিয়ার অপশন বাচ্চাদের ভাবতে দেওয়া হয় না। বাছতে দেওয়া হয় না। মা-বাবার ইচ্ছাই শেষ কথা। “এখানে তাহলে লুকিয়ে এসেছিস?” অভিমন্যু চুপ করে থাকলো। “ফটোগ্রাফি তাহলে পারসিউ করতে পারবি না, তাই না?” অভিমন্যু মরিয়া হয়ে ম্যামের হাত চেপে ধরলো। “প্লিজ ম্যাম। তাড়িয়ে দিও না। প্লিজ। লুকিয়ে এসেছি, জানি – ভুল করেছি। কিন্তু আমি চাই ফটোগ্রাফি পারসিউ করতে। কেমিস্ট্রি অনার্স পড়তে। এইচ এস-টা হোক। আমি মা’কে বলবো। তুমি প্লিজ শিখতে দাও।
” অনুস্মিতা অভিমন্যুর চোখে জল দেখলো। একবার ভেবেছিলো বাড়িতে লুকিয়ে আসছে ছেলেটা – আসতে মানা করে দেবে। ওর মা বাবা জানলে সমস্যা হবে। পরক্ষণেই অভিমন্যুর চোখে ফটোগ্রাফির জন্য প্যাশন দেখতে পেলো। ওকে না করবে না অনুস্মিতা। “বেশ, আসিস। শোন না বাবু – আমার একটা পুরনো ডি এস এল আর আছে। ওটা নিয়ে যা, বাড়িতে প্র্যাকটিস করবি।” অভিমন্যু চমকে গেলো, “তোমার ডি এস এল আর? আমায় দিয়ে দেবে?” অনুস্মিতা ওর পিঠে হাত রাখলো, “অফকোর্স দেবো। তোর প্যাশন আছে বিষয়টাতে। আমি এতো ভালো ছাত্র পাইনি যে আগে!” “আমি পারবো? ঠিক জানো?” অনুস্মিতা মাথা নাড়লো, “একদম। পারবি।” অভিমন্যু ম্যামের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে আনলো। এভাবে কেউ ওকে কখনো বলেনি, ও পারবে। ভারি আনন্দ হচ্ছিলো ওর। অদ্ভুত একটা কষ্টও হচ্ছিলো। কান্নাও পাচ্ছিলো, “কাঁদছিস কেন?” “আমি পারবো কেউ বলেনি যে আগে।” অনুস্মিতা অভিমন্যুকে কাছে টেনে আনলো। ওর কাঁধে হাত রাখলো। বড্ড একা ছেলেটা। টিন এজের অভিমানী সময় দিয়ে যাচ্ছে। ওকে আগলে রাখতে ইচ্ছা করলো। “কেউ না বললেও আমি বললাম। হবে না? আর কাউকে বলতে হবে?” অভিমন্যু মাথা নাড়লো। না আর কাউকে বলতে হবে না। ম্যাম বললেই হবে।
পরের মাসখানেকে ম্যাম কেবল অভিমন্যুর ক্রাশই না, ফ্রেন্ড, ফিলোজফার আর গাইডও হয়ে গেছে। অভিমন্যুর ঘুম ভাঙে ম্যামকে গুড মর্নিং বলে। ঘুমোতে যায় ম্যামকে গুড নাইট বলে। সারাক্ষণ ম্যাম কি করছে না করছে, ঠিক সময় খাচ্ছে কি না, ঠিক সময় স্নান করছে কি না, ঘুমোচ্ছে কি না সেসব দিকেও নজর রাখে অভিমন্যু। পড়াশোনাটা তবে মন দিয়ে করতে বলেছে ম্যাম। চেষ্টা করে অভিমন্যু। ম্যামের সাথে এক্সিবিশনে গেছে ও। ম্যামের ফটোগ্রাফির। কতো মিডিয়া এসেছিলো, সবাই ম্যামকে কতো প্রেইজ করছিলো। সানডে করে গ্রুপ ডিসকাশনের ছুতোয় ম্যামের বাড়ি চলে যায় অভিমন্যু। রিশিনকে রাজি করানোও আছে। ওর বাড়ি গড়িয়া। মায়ের চোখ ওতো দূর যাবে না। সানডে দুপুর থেকে সন্ধ্যা ম্যামের কাছে। দারুণ সময় কাটে অভিমন্যুর। ওরা গাড়ি নিয়ে বেরোয়। ম্যাম ড্রাইভ করে। বিভিন্ন লোকেশনে যায়। ম্যামের ক্যামেরা নিয়ে। তারপর শ্যুট করে ম্যাম। অভিমন্যু এসিস্ট করে। একবার সাহস করে ম্যামকে জিজ্ঞাসা করেছিলো অভিমন্যু ম্যামের বয়ফ্রেন্ড আছে কি না। ম্যাম হেসে ফেলেছিলো, “বয়ফ্রেন্ড? ঠিক বয়ফ্রেন্ড বলা যায় না।” “তবে? কেউ আছে? বলো না।” ম্যাম আর ও লেকের বেঞ্চে বসেছিলো, শ্যুট করার পর। “আছে। কেউ আছে। সাম ওয়ান স্পেশাল।” অভিমন্যুর বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধেছিলো কথাটা, “ওহ।
তাহলে বিয়ে করো না কেন?” “কী করে করবো? তিনি তো বিবাহিত।” “এমা! এমন লোককে বাছলে কেন?” অনুস্মিতা মৃদু হাসলো, “বেছে বেছে ভালোবাসা হয় নাকি? ভালোবাসা যার সাথে হবার তার সাথেই হয়।” অভিমন্যুর বুকের ভেতরটা হু হু করছিলো। কিন্তু ম্যাম তো ভুল বলছে না। ও জানে। ঠিক বলছে ম্যাম। ভালোবাসা বেছে বেছে হয় না। কোন যুক্তি মেনেও হয় না। তাহলে ম্যামকে ও ভালোবাসে কেন? তাও নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। নিজেকে সামলায় অভিমন্যু, “সে-ও… আই মিন তিনিও ভালোবাসেন তোমায়?” অনুস্মিতা মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ, বাসেন।” “তাহলে ডিভোর্স দেন না কেন ওয়াইফ-কে?” অনুস্মতি নিজে থেকে অভিমন্যুর হাত ধরে, “সব কিছু এতো সহজে হয় না, বাবু।” “তুমি তাও ওনাকেই ভালোবাসবে? ওনার জন্যেই ওয়েট করবে?” অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বলে চলেছিলো অভিমন্যু। “কেন করবো না? উনি যে ভালোবাসেন আমায়? অনেক বড় আমার থেকে – জানিস?
বছর পনেরোর। আমার কলেজের স্যার ছিলেন। মফঃস্বল থেকে সদ্য কলকাতায় এসেছি আমি তখন। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলা যায়। দারুণ পার্সোনালিটি। তেমন ভালো পড়ান। সারাক্ষণ ক্লাসে ওনাকেই দেখে যেতাম। ক্লাসমেটরা হাসতো আমার উপর। অবাস্তব ক্রাশ ভাবতো।” অভিমন্যু ম্যামের চোখে জল দেখলো। ম্যামও তাহলে অভিমন্যুরই মতো। একতরফা ভালোবেসে কষ্ট পায়। “তারপর?” “তারপর একদিন সাহস করে পড়া বুঝতে না পারার অছিলায় কাছে গেলাম। হাসি মুখে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর পার্সোনালি পড়তে চাইলাম, না করে দিয়েছিলাম, জানিস?
আমিও নাছোড় বান্দা, অনেক পিছনে পড়ে থেকে অবশেষে রাজি হলেন – পড়াতে।” অভিমন্যু মুচকি হাসলো। অভিমন্যুর মতোই ম্যামও পাগলামো করেছিলো তার মানে। টিন এজে। ক্রাশের সাহচর্য পাওয়ার জন্য। “তারপর কলেজ ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে পড়া শেষ হলো। তাও আমি ওনাকে ছাড়লাম না। উনিও আমাকে তাড়ালেন না। বড্ড একা মানুষটা পারিবারিক জীবনে। এই যে দেখছিস আমার ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়া, নাম করা, এগোনো সব ওনার চেষ্টায়। মা-বাবা তো এসব বোঝেই না। আমাকে শিলিগুড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতো এতোদিনে। উনি নিজে শিল্পী – তাই শিল্পের কদর বোঝেন।” অভিমন্যু ম্যামের মুখটা দেখেছিলো। বড্ড উজ্জ্বল লাগছে ম্যামকে। পূর্ণ, তৃপ্ত। আর প্রশ্ন করে বিরক্ত করেনি তাই। কষ্ট হয়েছিলো ওর। ম্যাম এনগেজড জেনে। আবার ম্যামকে ছাড়বে একথা মনেও আনতে পারেনি কখনো। থাকুক ম্যামের বয়ফ্রেন্ড নিজের মতো। ম্যাম আর অভিমন্যুর মাঝে তো আর আসছে না? তাছাড়া লোকটা যদি কখনো ম্যামকে ছেড়ে দেয় – তখন ম্যামের কি হবে? অভিমন্যু পাশে না থাকলে ম্যামকে সামলাবে কে? ম্যামকে ছেড়ে কক্ষণো যাবে না অভিমন্যু।
ম্যামের বাড়ি সেদিন স্কুল ছুটি হতে না হতেই চলে এসেছিলো অভিমন্যু। ম্যাম নেই। মাসি বসতে দিলো। ভাতও বেড়ে দিলো। ম্যাম বলে গেছে, বাবু এলে খেতে দিতে। ম্যাম অভিমন্যুকে বাবুই বলে সবসময়। অভিমন্যু মানা করেনি। ম্যাম বলে ভালো থাকলে থাকুক। আজ অনেক কটা ছবি তুলে এনেছে অভিমন্যু। ডি এস এল আর-টা অনেক কায়দা করে লুকিয়ে রাখে ও। কাছ ছাড়া করে না কখনো। মায়ের হাতে পড়লেই শেষ। সব জেনে যাবে মা। আজ সকালে মায়ের মুড ভালো ছিলো না। বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে মনে হয়। এমনটা ছোট থেকেই দেখে এসেছে অভিমন্যু। মা ঝগড়া করবে – বাবা সকালে না খেয়েই কলেজ চলে যাবে। মা সারাদিন রেগে থাকবে, খিট খিট করবে। বকুনি, মারগুলো অভিমন্যু খাবে। বাবার সাথে মা’কে কখনো কম্প্যাটেবল মনে হয় না অভিমন্যুর। কী করে যে বিয়ে করেছিলো ওরা কে জানে। বাবার সাথে ঝগড়া হওয়ার পর মা-ও আজ বকেছে অভিমন্যুকে। অভিমন্যু কিছু মনে করেনি। গা সওয়া হয়ে গেছে এটা ওর।
ম্যামের বাড়ি এসে সোফায় শুয়ে পড়লো অভিমন্যু। টায়ার্ড লাগছে। ম্যাম আসুক, একটু ঘুমিয়ে নেবে ও ততক্ষণে। হঠাৎ-ই ম্যামের সেন্টার টেবিলের তলার র্যাকে একটা বই চোখে পড়লো ওর। বাবার লেখা বই না! উৎসাহ বশত বইটা হাতে নিলো অভিমন্যু। শুয়েছে বলেই নজরে পড়েছে বইটা, বসে থাকলে পড়তো না। বইটা খুলে নিদারুণ চমকালো অভিমন্যু। এতোটা জীবনেও চমকায়নি কখনো। বইয়ের প্রথম পাতাতেই লেখা “অনুকে ভালোবাসার উপহার – প্রিয়ব্রত।” বাবার হাতে লেখা। বইয়ের পাতার মাঝে আরো একটা জিনিস পেলো অভিমন্যু। একটা ছবি। ম্যাম আর বাবার। কাপলদের মতো করে। ভীষণ খুশি দুজনেই। কলেজ, প্রফেসর, শিল্পী – দরদর করে ঘামছিলো অভিমন্যু। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিলো ওর। বুকের বাঁদিকটা যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিলো। বইটা ভাঁজ করে ফেললো অভিমন্যু। উঠে দাঁড়ালো ও। বইটাকে নিজের রেখে, “মাসি- আসছি আমি।” “হঠাৎ? দিদিমণি চলে আসবে তো এক্ষুনি।” অভিমন্যু বললো, “মা ডাকছে, আসছি গো।” প্রায় দৌড়েই চলে গেল অভিমন্যু।
সুদর্শনা কলেজের সামনে ছেলেকে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। “এখন এখানে তুই? টিউশন নেই?” অভিমন্যু হঠাৎ-ই মা’কে জড়িয়ে ধরলো। ছোট থেকে কখনো মা’কে ও জড়িয়ে ধরতে পারেনি, এভাবে। ভয়ে, জড়তায়। আজ পারলো। কোন ভয় পেলো না ও। কোথাও আটকালো না। ওর মায়ের দরকার ওকে। সুদর্শনা বুঝলেন ছেলের কিছু একটা হয়েছে। মাথায়, পিঠে হাত রাখলেন। “চল্, বাড়ি যাই। আজ পড়তে যেতে হবে না।” অভিমন্যু আরও আঁকড়ে ধরলো মা’কে। সুদর্শনা ছেলের কানে কানে বললেন, “সবাই দেখছে, পাগল।” “দেখুক। তুমি আমার মা, মা’কে জড়িয়ে ধরেছি তো কি হয়েছে।” সুদর্শনা ছেলেকে চুমু খেলেন বহুদিন পর। “ছাড় বাবু। বাড়ি যাই, তারপর না হয় আদর করে দিস মা’কে।” বাবু! মা ওকে বহুদিন পর বাবু বললো। বাবা ওকে বাবু বলে। তাও কালেভদ্রে। আর একজন তো সবসময় বাবু বলতো। বাবুই বলতো শুধু। তাহলে সে কি সব জানতো? অভিমন্যু কার ছেলে?
জেনেও তাহলে এতটা কাছে আসতে দিলো কেন? বাবা, বাবাও কী জানে তাহলে সব? অভিমন্যু যে যায় তার কাছে। “বাবু – চলো। বাড়ি যাব আমরা।” সুদর্শনা ছেলেকে আর একটু আদর করে বললো। অভিমন্যু মা’কে ছাড়লো, চোখ মুছলো। “মা-” “বল্।” “আই লাভ ইউ।” “জানি তো।” “বাবা না বাসলেও আমি বাসি।” সুদর্শনা ছেলের আবেগটা বুঝলো। “বাবা সকালে ঝগড়া করেছে, তাই! অমন তো করেই। তা বলে ভালোবাসেনা, তা নয়। চল্।” অভিমন্যু মায়ের হাত ধরলো। ওর মা বড্ড বোকা। সত্যিটা দেখতেই পায় না। অভিমন্যু মা’কে সত্যিটা বলবে না কখনো।
শুধু আগলে রাখবে এবার থেকে। ঠকতে দেবে না আর। মা যা বলে শুনবে ও। মায়ের যে ভীষণ কষ্ট। মায়ের চারিদিকটা যে বড্ড ফাঁপা আর ফাঁকা। “বাড়ি চলো মা। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে দেবে?” সুদর্শনা ছেলের পিঠে হাত রাখলেন, “তোর মা তোর মায়ের কোল, তুই মাথা রেখে শুবি। এটাও বলতে হয়?” অভিমন্যুর আর কিছু জানবার নেই। মা ভালোবাসে ওকে, তাহলেই হবে। ও ভুল জানতো এতোদিন। খুব ভালোবাসে। – সমাপ্ত